শান্তিনিকেতন: ভারতীয় সংস্কৃতির একটি সাধনা ক্ষেত্রের গোড়ার কথা

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বীরভূমের রুক্ষ প্রান্তরে যে আশ্রমের সূচনা করেছিলেন তা দেবেন্দ্র-রবীন্দ্রের মহিমায় এবং বহু আদর্শনিষ্ঠ মানুষের সাধনায় আজ তা শিক্ষা ও সংস্কৃতির এক জাতীয় মহাতীর্থে পরিণতি পেয়েছে। বর্তমানে এটি ভারতীয় সংস্কৃতির একটি সাধনা ক্ষেত্র। অতীতে এটি ছিল খুনে-ডাকাত ঠাঙারেদের একচ্ছত্র লীলাভূমি। বন্ধ্যাভূমি থেকে এক মহামন্দিরে সমুত্তরণের শান্তিনিকেতনের এই পূর্বকথা আজ প্রায় বিস্মৃত।

দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে সুরুল গ্রামের পাশে রায়পুরের সিংহ পরিবারের যথেষ্ট সখ্যতা ছিল। মাঝে মাঝে পরিব্রাজক জীবনে যখন শীতে তিনি পাহাড়ে আর থাকতে পারতেন না তখন সমতলে নানা জায়গায় নদীতে নৌকায় অথবা ট্রেন ও পালকিতে ভ্রমণ করে দিন কাটাতেন ও সর্বসময়ে ঈশ্বরচিন্তায় ও ধ্যানে নিমগ্ন থেকে সময়। অতিবাহিত করতেন। ধ্যানের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যে পেরিয়ে যেত। এই পরিব্রাজক জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি প্রায়ই বোলপুর হয়ে পায়ে চলা পথে বাহকদের দ্বারা বাহিত হয়ে রায়পুরে আসতেন। সে সময়ে অজয় নদীর উপর রেলের সেতু না থাকায় বোলপুর রেল স্টেশনের কোন চিহ্ন ছিল না। অজয়-এর সেতু তৈরি হয় ১৩ই অক্টোবর ১৮৫৮ (২৮-এ আশ্বিন ১২৬৫) তাই বোলপুর সাঁইথিয়া রেলপথ খোলার আগে দেবেন্দ্রনাথ কীভাবে রায়পুরে আসতেন তাই নিয়ে বেশ কিছু সংশয় আছে।

রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে, পাহাড় থেকে নেমে জলপথে কলকাতা যাওয়ার পথে ভাগীরথীর উপর কাটোয়া হয়ে গুনুটিয়া ঘাটে নামতেন ও সেখান থেকে তিনি নীলকর চিফ সাহেব নদীপথে মাল সরবরাহের জন্য গুনটিয়া নদীর ঘাট থেকে সুরুল গ্রাম পর্যন্ত যে রাস্তাটি তৈরি করেছিলেন সেই পথেই তাঁর বিশেষ ভক্ত রায়পুরের জমিদার প্রতাপনারায়ণ সিংহের গৃহে যাতায়াত করতেন। এই রাস্তাটি ছিল তখনকার দিনে অতি ভয়াবহ। তা ছিল সেই রূপকথার তেপান্তরের মাঠ। পথে শুধু ভুবনডাঙ্গা নামে একটা অতি ছোট্ট লোকালয়। কয়েক ঘর বাগদি জাতের লোকের বাস। তারপরই রুক্ষ ধূসর চোরকাঁটায় ছাওয়া সীমাহীন প্রান্তর ছড়িয়ে আছে যেদিকে চোখ যায় সেই দিকে। সেই আকাশছোঁয়া প্রান্তরের মাঝে ক্ষুদে-ক্ষুদে বেঁটে খেজুরের ঝোপঝাড় আর দূরে আকাশে ও মাঠে মিলনের গাঁটছড়া যেখানে বেঁধেছে সেখানে সুদূর নীল আকাশের পটভূমিকায় ছড়ানো ছিটোনো তালের সারি। তার ভিতর দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ নানা দিকে চলে গেছে দূর-দূরান্তে পল্লীগ্রামের গা ছুঁয়ে। এই বিস্তীর্ণ মরুর মাঝে রায়পুরের পথে একটা ছোট্ট মরূদ্যান ছিল।

Santiniketan 1929

যখন গ্রীষ্মকালে মাঠের উপর দিয়ে গরম হাওয়ায় “লু” চলত তখন ঐ প্রান্তরের প্রখর সূর্যের আলো চোখের দৃষ্টিকে এলোমেলো করে দিত। সেই সময় ঐ ধু-ধু করা প্রান্তরের মাঝে মরূদ্যানে দুটি ছাতিম বা সপ্তপর্ণীর ছায়া ছিল ক্লান্ত ক্ষুধার্ত পথিকের একমাত্র আশ্রয়ের স্থান। দেবেন্দ্রনাথ রায়পুরে আসার ও ফেরার পথে প্রতিবার এইখানে বৃক্ষের ছায়ায় তাঁর সাদা তাঁবুটি খাটাতেন ও বিশ্রাম নিতেন।

১৮৫৮ সালে অজয়ের সেতু নির্মিত হওয়ার পর বোলপুর স্টেশন তৈরি হয়। সে সময়ে উত্তর ভারতের সঙ্গে কলকাতাবাসীর যোগাযোগের এই একমাত্র রেলপথ। তখন প্রায় প্রতি বছর গ্রীষ্মে হিমালয় যাওয়ার ও সেখান থেকে ফেরার পথে দেবেন্দ্রনাথ দেখা করে যেতেন প্রিয় বন্ধু ও শিষ্য রায়পুরের জমিদার প্রতাপনারায়ণের সঙ্গে। ঐ ছায়াবিহীন প্রান্তরের মাঝে প্রখর সূর্যরশ্মি বিকীরিত প্রান্তরে এই ছাতিম গাছ দুটি এক স্নিগ্ধ ছায়া সৃষ্টি করত যা পথিকের ক্লান্তি নিবারণের স্থান বলে গণ্য হত। আবার আরেক দিকে গভীর রাতে ডাকাত দল জড়ো হওয়ার এবং তার তলায় লাশ পোঁতার ব্যবস্থাও চলত। তাই মনে হয় বীরভূমে শাক্ত ধর্মের তান্ত্রিক ধ্বজা বহন করে অনেক পথিকের বহু রক্ত ঝরানো হয়েছে ঐ ছাতিমতলার মাটিতে। তাই সে সময়ে ঐখানে রাত্রিযাপন একটা মহা ভয়ের ব্যাপার ছিল। পাশের ভুবনডাঙ্গা গ্রামটি ছিল ডাকাত দলের আড্ডা। গ্রামের লোকজন সকলেই ডাকাতির উপার্জনে দিন কাটাত। দূর দূর গ্রামে ডাকাতি করে জিনিসপত্র সোনাদানা লুঠ করে এই তেপান্তরের মাঠে গা ঢাকা দিত ও কোন লাশ থাকলে তা ঐ মরূদ্যানের ছাতিমতলায় এনে পুঁতে ফেলত। তাই ছাতিমতলা ছিল নরকঙ্কালে ভরা এক অভিশপ্ত স্থান। তবে সেটা হয় তো দেবেন্দ্রনাথের অগোচরে থাকায় তিনি এই মৃত্যুপুরীর বুকেই তাঁবু খাঁটিয়ে রাত্রিযাপনের আয়োজন করতেন। কোন একদিন দেবেন্দ্রনাথ ফিরছিলেন রায়পুরের বন্ধুর আবাস থেকে পালকি করে বোলপুর স্টেশনের পথে। তখন সন্ধ্যা হব-হব। সূর্য বসেছে পশ্চিমপাটে, হঠাৎ তিনি পালকি থেকে দূরে ছাতিম গাছ দুটির পাতা কাঁপা নীরব আহ্বান অন্তরে অনুভব করলেন। তিনি ছাতিমের ঐ ডাক প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না। পালকি থেকে নেমে সেই জনহীন প্রান্তরের একটেরে নরকরোটিপ্রোথিত ছাতিমের তলায় তাঁর সারা জীবনের প্রতিদিনের নিয়ম অনুসারে পশ্চিমের সূর্যাস্তের দিকে মুখ করে ধ্যানে আত্মস্থ হলেন।

শান্তিনিকেতন
শ্রীনিকেতন
বিশ্বভারতী

গল্পকথা